বৃষ্টি ও কুর’আন: জীবন ও ঈমান

আল্লাহ আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন, তা দ্বারা যমীনকে তার মৃত্যুর পর পুনর্জীবিত করেন। নিশ্চয় এতে মনোযোগ দিয়ে শ্রবণকারীদের জন্যে রয়েছে নিদর্শন। [নাহল: ৬৫]

এখানে আসলে বৃষ্টির কথা বলা মুখ্য উদ্দেশ্য না৷ উদ্দেশ্য পূর্বের আয়াত। আগের আয়াতে যা বলা হয়েছে তা হচ্ছে:

আমি আপনার প্রতি এ জন্যেই কিতাব নাযিল করেছি। (নাযিলের উদ্দেশ্য) যাতে আপনি সরল পথ প্রদর্শনের জন্যে তাদেরকে পরিষ্কার বর্ণনা করে দেন (ঐসব বিষয়ে) যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করছে এবং(এই কিতাব) ঈমানদারকে হেদায়াত ও তাদের জন্যে ক্ষমা (নিয়ে আসবে)। [সূরা নাহল: ৬৪]

পূর্বের আয়াতে বলা হয়েছে আল্লাহ তা’আলা আসমান থেকে কিতাব নাযিল করেন। পরের আয়াতে বলা হয়েছে আল্লাহ আসমান থেকে পানি বর্ষণ করেন। সুতরাং আপনি যদি পৃথিবীতে আল্লাহর কিতাবের গুরুত্ব বুঝতে চান, তাহলে আপনাকে পৃথিবীতে পানির ভূমিকা বুঝতে হবে। বলুন তো পানির কাজ কী? পানি পৃথিবীতে জীবন তৈরি করে৷ পৃথিবীতে জীবন ধারণের জন্য পানি অপরিহার্য। ঠিক তেমনি জগতের যেসব জায়গা নীতি-নৈতিকতার দিক থেকে মৃত, সেখানে আল্লাহর কিতাবের শিক্ষা অনিবার্য৷ আধ্যাত্মিকভাবে মৃত জগতকে জাগাতে চাই কুর’আনের শিক্ষা৷ হাজার বছরের মৃতপুরীকে জাগিয়ে তুলতে পারে পানি৷

পৃথিবীর রাজনৈতিক অবস্থা যতই খারাপ হোক না কেন, পৃথিবীর নৈতিক অবস্থা যতই খারাপ হোক না কেন, দিন রাতে যেকোনো অবস্থাতেই মিডিয়া যতই খারাপ হোক না কেন, মুসলিমরা যতই নীচে নামুক না কেন — এই কিতাব (মহিমান্বিত কুর’আন) সেই মৃত লোকদের মধ্যে জীবন আনার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু পানি যখন বর্ষিত হয় তখন দুই ধরনের উদ্ভিদ জন্মায় পানি বর্ষণের ফলে। এক ধরনের উদ্ভিদ যা নিজে নিজে জন্মায়। আরেক ধরনের উদ্ভিদ হচ্ছে ফসল৷ এর জন্য শ্রম দিতে হয়৷ পৃথিবীতে কি এমন লোক নেই যাদেরকে কোনো প্রকার সরাসরি দাওয়াত ছাড়া ইসলাম গ্রহণ করেছে? অনেকে করেছে। যাদের সাথে কোনো অবস্থাতেই আমার দেখা হয়নি। আমি শুধু একটি ইউটিউব ভিডিও তৈরি করেছি এবং সেটা দেখে তারা সেখানে মন্তব্য করেছে, “হ্যালো, আমি এক সময় খ্রিস্টান ছিলাম, আপনার ভিডিও দেখেই আমি মুসলিম হয়েছি। তারপর আমার পরিবারকে এই বিষয়ে বলেছি, তারাও মুসলিম হয়েছে। আমরা আপনার সাথে ছবি তুলতে চাই, পারবো?” আমি উল্টো বলেছি, “আমি কি আপনার সাথে ছবি তুলতে পারবো?” কিন্তু আমি কি তাদের কিছু করেছি? না, বরং আল্লাহর কিতাব সেই কাজ করেছে।

কোনোভাবে তাদের কাছে পৌঁছে গেছে। এর মানে কী এটা না যে তারা আল্লাহর ইচ্ছায় নিজেরা হেদায়াত পেয়েছেন? কারণ, আল্লাহ যাকে চান ঈমান দ্বারা তার অন্তর পরিবর্তন করে দেন। আমি অতি অল্প যা করেছি আল্লাহ তা পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন নিজ ইচ্ছেতে৷ বৃষ্টির মধ্যেও কিছু সুন্দর জিনিস আছে যেটা তিনি বলেছেন এভাবে — তোমরা যে পানি পান কর, সে সম্পর্কে ভেবে দেখেছ কি? — তোমরা তা মেঘ থেকে নামিয়ে আন, না আমি বর্ষণ করি? [সূরা ওয়াকিয়াহ: ৬৮-৬৯] আমি এমন কোনো ক্ষমতা রাখি না যে আল্লাহর কথা কারো অন্তরে প্রবেশ করিয়ে দেব। আমি শুধু একটু চেষ্টা করতে পারি। বৃষ্টি যেভাবে বর্ষিত হচ্ছে, এই কথাও সেভাবেই পৌঁছাবে। কিন্তু পানি কি আসমান থেকে বালতির মাধ্যমে আসে আর আপনি সেটা সংগ্রহ করেন, নাকি সেটা নিজেই সবার কাছে পৌঁছে? এটা নিজে নিজেই সবার কাছে পৌঁছে। কিন্তু আসমান থেকে যখন কোনো কিতাব নাযিল হয় তখন সেটি একজন রাসুলের কাছে পৌঁছে। এটা শুধু একজন মানুষের কাছেই পৌঁছে এবং তারপর সেই মানুষটাকে একটা উদ্দেশ্যে কাজ করতে হয়। সবার কাছে তিনি সেই কিতাবের বাণী পৌঁছে দেন৷ যাদের কাছে সেই কিতাব পৌঁছে দিলেন সেই লোকদের কী কাজ করতে হবে এরপর? তাদেরকেও সেটা অন্যদের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। আল্লাহ সবার কাছে তার কিতাব প্রেরণ করবেন না, আমাদেরকে সেটা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে বুঝতে পারছেন বৃষ্টির সাথে আমাদের একটু মিল আছে। কুর’আনের সাথে বৃষ্টির মিল থাকলেও একটা পার্থক্য আছে। বৃষ্টির পানিকে আমাদের সংগ্রহ করে বিতরণ করতে হয় না। একটা কথা চিন্তা করেন, যদি মানুষকে পৃথিবীতে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে বিতরণ করার দায়িত্ব দেয়া হতো, তাহলে পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যেত। কিন্তু আমাদের পৃথিবীতে আল্লাহর কিতাবকে প্রচার করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আমরা কি তাহলে সেই কাজ ভালভাবে করছি? আমি দ্বিমত পোষণ করে বলব, না।

কিন্তু আমি বলব, আমরা সেই দায়িত্ব অত্যন্ত বাজেভাবে পালন করছি। অমুসলিমদের কথা বাদ দিন, আমরা নিজেদের মুসলিমদের প্রতি সেই দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করছি না। কারণ, আমরা এটাকে কঠিন বানিয়ে ফেলেছি। আমরা ঠিকমতো সেই দায়িত্ব পালন করতে পারিনি। বৃষ্টি যেমন একটি রহমত; সেটা কিন্তু আযাব নয়। আমরা এই প্রচারের দায়িত্বকে আযাব বানিয়ে ফেলেছি। আপনি যদি পাকিস্তান, বাংলাদেশ, কুয়েত, বাহরাইন, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া যেখানেই সে বাস করুক না কেন, এমন একটি ১০ বছরের ছেলে বা মেয়েকে জিজ্ঞাসা করেন “কুরআনে কী বলা আছে ?” সে উত্তর দিবে, “কুর’আন বহু জিনিসকে হারাম ঘোষণা করে দিয়েছে আর এসব করলে আল্লাহ ভীষণ রাগ করেন!” এটা তারা কার কাছ থেকে শিখেছে? তাদের বাবা-মায়ের কাছ থেকে। আমরা শুরু থেকেই তাদেরকে ভয়-ভীতি দেখাই। আমরা কুর’আনের তিলাওয়াত শুনি। আপনারাই বলেন আল্লাহ কুর’আনের শিক্ষাকে কী নামে পরিচিত করিয়ে দিয়েছেন? করুণাময় আল্লাহ। (যিনি) শিক্ষা দিয়েছেন কুর’আন। (তিনি) সৃষ্টি করেছেন মানুষ। (আর) তাকে শিখিয়েছেন ভাষা। [সূরা আর-রাহমান: ১-৪] আল্লাহ তা’আলার কুর’আন শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে সেই দয়া কোথায়? আপনি বুঝতে পারছেন, এটা আমাদের জন্য ভয়ানক সমস্যা। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে এ সমস্যা থেকে রক্ষা করুন, কুর’আনকে আমাদের অন্তরের রহমতের পরশ হিসেবে ঢেলে দিন। আমীন। – উস্তাদ নোমান আলী খানের বই “উপমার শৈল্পিকতায় মুগ্ধময় কুর’আন” থেকে নেওয়া।

যেখানে পাবেন: রকমারি: 16297 : https://tinyurl.com/ROKOMARIBOOKISH

বৃষ্টি ও কুর’আন: জীবন ও ঈমান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to top
Generated by Feedzy