সবচেয়ে বিশুদ্ধ বুদ্ধির মানুষ কারা?

— নোমান আলী খান।      

মানুষের মাঝে যাদের সবচেয়ে পরিপক্ক ঈমান রয়েছে কুরআনে তাদের জন্য একটি পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, আর তা হলো – উলুল আলবাব বা সবচেয়ে পরিশুদ্ধ বুদ্ধির মানুষ। 

আল্লাহ এই মানুষদের কথা সূরা আলে-ইমরানে বলেছেন – إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَآيَاتٍ لِّأُولِي الْأَلْبَابِ – “নিশ্চয়ই আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টিতে এবং রাত্র ও দিনের আবর্তনে জ্ঞানবানদের (উলুল আলবাবদের) জন্য বহু নিদর্শন আছে।” (৩:১৯০)  

 তারা ঈমানের বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধানে এবং ঈমানের আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানে এক ধরণের পরিপক্কতায় পৌঁছে গিয়েছে, এমনকি কুরআনের সংস্পর্শে আসার পূর্বেই। সবচেয়ে পরিণত ঈমানের মানুষেরা ঐশী জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পাওয়ার পূর্বেই নিজেদের ভেতর বিশ্বাসের ভিত গড়ে তুলেছিলেন। 

চলুন দেখি, কীভাবে? আল্লাহ বলেন – “ইন্না ফিই খালকিস সামাওয়াতি ওয়াল আরদি ওয়াখতিলাফিল লাইলী ওয়ান নাহারি…” নিশ্চয়ই নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টিতে এবং রাত্র ও দিনের আবর্তনে  “লাআ-ইয়াতিন” অলোকিক নিদর্শন রয়েছে, শুধু একটা নয়, বহু বহু নিদর্শন রয়েছে এর প্রত্যেকটাতে। রাতের মাঝে অনেক শিক্ষা আছে, দিনের মাঝে অনেক শিক্ষা আছে, আকাশের মাঝে অনেক শিক্ষা আছে, পৃথিবীর মাঝেও অনেক শিক্ষা আছে। এর প্রত্যেকের মাঝে রয়েছে অনেক অনেক শিক্ষা। কার জন্য? 

উলুল আলবাব-দের জন্য। সবচেয়ে পরিশুদ্ধ বুদ্ধির মানুষদের জন্য, খাঁটি বুদ্ধিমত্তার অধিকারী মানুষদের জন্য। এখন, খাঁটি বুদ্ধিমত্তার সংজ্ঞা কী? আল্লাহ কিভাবে খাঁটি বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন? 

তিনি পরবর্তী আয়াতে “উলুল আলবাব-দের” পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন – الَّذِينَ يَذْكُرُونَ اللَّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَىٰ جُنُوبِهِمْ وَيَتَفَكَّرُونَ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ – যাঁরা দাঁড়িয়ে, বসে, ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং চিন্তা-গবেষণা করে আসমান ও জমিন সৃষ্টির বিষয়ে….

তাহলে উলুল আলবাবদের প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো, যারা সবসময় আল্লাহকে স্মরণ করে। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল, “ওয়া ইয়াতা ফাক্কারুনা ফিই খালিকস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ” এবং তারা আকাশ ও জমিনের সৃষ্টি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে। 

তাহলে এখন দেখুন… আগের আয়াতে কোন উৎসগুলোর কথা বলা হয়েছে যেখান থেকে এই মানুষেরা তাদের ঈমান গড়ে তুলেছিল? আসমানসমূহ, দুনিয়া, দিন এবং রাতের আবর্তন। এটাই তাদের সোর্স মেটেরিয়াল। এটাই তারা অধ্যয়ন করছে। এটা নিয়েই তারা চিন্তা করছে, এটাই তারা পর্যবেক্ষণ করছে। তারা কোনো বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে না, তারা কোনো ধর্ম অধ্যয়ন করছে না, তারা তাদের চারপাশের দুনিয়াকে পর্যবেক্ষণ করছে। বিশেষ করে আল্লাহর কাজ, প্রকৃতির কাজ। 

পরের আয়াতে বলা হয়েছে তারা দুইটি কাজ করে। কিভাবে জানেন এরা পরিশুদ্ধ বুদ্ধির অধিকারী? তারা দুটো কাজ করে। কি কি সেগুলো? তারা আল্লাহকে স্মরণ করে এবং গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে।  

আল্লাহকে স্মরণ করা হলো আধ্যাত্মিক অনুশীলন। আর চিন্তা করা হলো বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলন। আল্লাহ আমাদেরকে এখানে বলছেন আকাশ, পৃথিবী, দিন, রাত তোমাকে আধ্যাত্মিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক খাদ্য সরবরাহ করবে। শুধু দিন, রাত্রি নিয়ে গভীর চিন্তাই আপনার চোখ দিয়ে অশ্রু নির্গত করতে পারে। যদি আপনি সত্যই আল্লাহকে নিয়ে চিন্তা করেন তাহলে রাতের আকাশ দর্শন আপনার অন্তর নাড়িয়ে দিতে পারে। আর এ নিয়ে চিন্তা হবে গভীর। এটা যে দৃষ্টিতে বাস্তবতা দেখেন তা পরিবর্তন করে দিবে। 

এখান থেকে আমাদের জন্য শিক্ষা হল, প্রকৃতি দেখার জন্য সময় ব্যয় করা, রাতের আকাশ দেখা, ভোরের পরিবেশ দেখা, সকালে একটু হাটতে বের হওয়া…কতজন মানুষ এগুলো করে এখন? জাস্ট, ভোরের প্রকৃতি দেখার জন্য বের হয়ে যান।  একটি গাছের ছায়ায় বসুন। শুধু এতটুকু করুন। আর এর জন্য আপনাকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা চমৎকার কোনো বিনোদন কেন্দ্রে যেতে হবে না। শুধু প্রকৃতির কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করুন। ইনশাআল্লাহু তায়ালা এর থেকে আপনি একটি অনুশীলন রপ্ত করতে পারবেন। যা আপনাকে আল্লাহ সম্পর্কে চিন্তা করার প্রেরণা যোগাবে এবং তাঁর স্মরণ করতে উদ্দীপনা জাগাবে, তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে। 

আর যখন কেউ যথেষ্ট পরিমাণে চিন্তা-ভাবনা করবে আধ্যাত্মিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে। এক সময় সে এমন একটি প্রশান্ত অবস্থায় উপনীত হবে যে সে বলে উঠবে – “রব্বানা মা খালাক্বতা হাজা বাতিলান” ইয়া রব! আপনি এসব অনর্থক সৃষ্টি করেননি। কোনোভাবেই সম্ভব নয়। “সুবহানাকা” আপনি এ ধরণের ত্রুটি থেকে মুক্ত। “ফাকিনা আজাবান না-র” আমাদেরকে আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন। 

গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করার পর এটাই এই ব্যক্তির উপসংহার। “আপনি এর কোনোটাই উদ্দেশ্যহীন সৃষ্টি করেননি। এর মানে হলো, আমাকেও উদ্দেশ্যহীন সৃষ্টি করা হয়নি। যদি আমার উদ্দেশ্য থেকে থাকে, তার মানে হলো, আমি আমার কাজের জন্য জিজ্ঞাসিত হব। আমি আগুনে পোড়া যেতে চাই না। “

আর কিভাবে সে জানলো যে জাহান্নামের শাস্তি আছে? “আমি বুঝতে পেরেছি যে অন্যায় করলে শাস্তি পেতে হবে। আমি পুরোপুরি জানতাম না। কিন্তু, আপনার রাসূল এসেছেন।” رَّبَّنَا إِنَّنَا سَمِعْنَا مُنَادِيًا يُنَادِي لِلْإِيمَانِ أَنْ آمِنُوا بِرَبِّكُمْ فَآمَنَّا ۚ رَبَّنَا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَكَفِّرْ عَنَّا سَيِّئَاتِنَا وَتَوَفَّنَا مَعَ الْأَبْرَارِ – “হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা একজন ঘোষণাকারীকে ঈমানের ঘোষণা করতে শুনেছি যে, ‘তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের প্রতি ঈমান আনো’। সে অনুযায়ী আমরা ঈমান এনেছি। হে আমাদের রব আমাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করুন এবং বিদূরিত করুন আমাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি, আর আমাদেরকে মৃত্যু দিন নেককারদের সাথে’।” (৩:১৯৩)

সবচেয়ে বিশুদ্ধ বুদ্ধির মানুষ কারা?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to top
Generated by Feedzy